সোমবার, ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২২ পূর্বাহ্ন
জগন্নাথপুর নিউজ ডেস্ক :: ঝালকাঠি লঞ্চ ঘাট। মানুষের ভিড়। পন্টুনের গ্যাংওয়েতে পুলিশি বাধা। উৎসুক সকলের দৃষ্টি নদীর দিকে। সেখানে বাঁধা আগুনে পুড়ে যাওয়া অভিযান-১০ লঞ্চটি। পন্টুনের ওপরে টহল দিচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। আছে গণমাধ্যম কর্মীদের আনাগোনা। নিখোঁজ স্বজনদের দু’একজন ঢুকছেন লঞ্চের ভেতর।
খুঁজে দেখছেন আগুনে আঙ্গার হয়ে যাওয়া আপনজনের শেষ চিহ্ন। লঞ্চে এখনো রয়েছে হতাহতদের রেখে যাওয়া নানা চিহ্ন। মৃতদের কারো হাতের চুড়ি, কানের দুল, হাতের বালা, গলার চেইন, বই, রান্না করা ভাত, ভাতের বাটি, জুতা, জামা ও মোবাইল। সবই পড়ে আছে লঞ্চের ডেকে। এ সবকিছু আগুনে পুড়ে আঙ্গার। কেবিনে সব কিছুই ছাই আর ছাই। সুগন্ধা নদীতে হালকা বাতাসেও উড়ে যাচ্ছে তা। আগুনের লেলিহান শিখায় ফেটে গেছে লঞ্চের ডেক। লোহার দণ্ডগুলো এলোমেলোভাবে একেবেঁকে আছে। সেখানে কেউ আছেন দেখতে, কিংবা ছবি তুলতে। তদন্ত কমিটিও দেখেছেন ঘুরে ঘুরে। সংগ্রহ করছেন নানা তথ্য। তবে এখন আর সুগন্ধা নদীর তীরে নেই মানুষের চাপ। গত ২ দিন স্বজনদের খোঁজে নদীর পাড়ে বরগুনা থেকে আসা মানুষের ঢল নামলেও নিখোঁজদের না পেয়ে ফিরে গেছেন অনেকে।
এদিকে লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য লঞ্চ কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেছেন সেদিনের বিভীষিকাময় স্মৃতি থেকে বেঁচে ফেরা যাত্রীরা। তাদের দাবি, ঢাকা লঞ্চঘাটেই ইঞ্জিনরুমে কাজ করেছেন লঞ্চের স্টাফরা। পরবর্তীতে চলন্ত পথেও ইঞ্জিনরুমে কাজ করতে দেখেছেন তারা। মধ্যরাতে ইঞ্জিনরুমে আগুন লাগলে তারা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। তবে যখন আগুন নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। তখন তারা সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। এসব পালিয়ে যায়। এরপর সেখানে বিকট শব্দ হয়। একাধিক যাত্রী বলেন, আগুন নিচতলায় ছড়িয়ে পড়লেও লঞ্চের স্টাফরা কোনো ঘাটে ভিড়াননি। লঞ্চটি চলন্ত অবস্থায় ছিল। এতে আগুন দ্রুত বেগে ছড়িয়ে পড়ে। এজন্যই এত বেশিসংখ্যক মানুষ পুড়ে মারা গেছেন। এমভি অভিযান-১০ কর্তৃপক্ষ সেদিন আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগে নদীর এক পাশে ঘাটে লঞ্চ ভিড়ালে এমনটি হতো না।
এদিকে, দুর্ঘটনাকবলিত এলাকায় গতকাল সকাল থেকে ফের উদ্ধার অভিযানে নামে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। ঘটনার পরবর্তী শুক্রবার দুপুরের পর নতুন করে মৃত কিংবা জীবিত উদ্ধার হয়নি কেউ। তবে এখনো নিখোঁজের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের তালিকায় এখনো ৪১ জন নিখোঁজ রয়েছেন। অন্যদিকে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির তালিকায় আছে ৫১ জনের নাম। তবে নিখোঁজদের তালিকা আরও দীর্ঘ- দাবি করছেন স্বজনরা।
এদিকে গতকাল রোববার দুপুরে পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি পরিদর্শনে আসেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স বিভাগের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান। পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তার প্রাথমিক পর্যায়ে আছি। এখন আমাদের বিভিন্ন টিম কাজ করছে। প্রত্যক্ষদর্শীও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের থেকে আমরা তথ্য সংগ্রহ করেছি। আমরা সরাসরি এটা পর্যবেক্ষণ করেছি যা চলমান থাকবে।
তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে তিনি বলেন, আশা করি আগামী ২ সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট সম্পন্ন করতে পারবো। তখন আমরা একটা ধারণা দিতে পারবো। সম্ভাব্য কোন কারণে অগ্নিকাণ্ড সৃষ্টি হয়। পর্যাপ্ত ফায়ার ফাইটার ছিল কিনা। তিনি আরও বলেন, আমরা যখন ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স ঘটনাস্থলে আসি, তখন সম্পূর্ণ লঞ্চে আগুন জ্বলছে। তখন প্রতিটি তলায় আগুন ছড়ানো ছিল। আগুনে লঞ্চের সম্মুখ থেকে পিছনের অংশ জ্বলছে। আগুনটা যখন সবচেয়ে ছোট আকারে সৃষ্টি হয়, যেহেতু রাতের বেলা ছিল, হয়তো এটাকে তারা শনাক্ত করতে পারেনি। অথবা যখন প্রাথমিক অবস্থায় ছিল, তখন সম্পূর্ণভাবে নিভাতে পারেনি। এটার প্রমাণও আমার দেখতে পেয়েছি। যার ফলে এখানে এতো লোক মারা যায়। অনেকে আহত হন। লঞ্চের অগ্নিনির্বাপক তেমন একটা কর্যকর ছিল না বলা যায়।
অন্যদিকে স্বজনহারা ব্যক্তিদের দাবি কমপক্ষে শতাধিক মানুষ প্রাণ বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে এখনো তারা নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের সন্ধানে সুগন্ধার তীরে অপেক্ষায় আছেন অনেকেই। কেউ আবার ট্রলার ও ছোট ছোট নৌকা নিয়ে নদীর বিভিন্ন প্রান্তে খুঁজে বেড়াচ্ছেন প্রিয়জনকে। কারো হাতে নিখোঁজদের ছবি। তা নিয়ে নদী তীরের বাসিন্দাদের দেখাচ্ছেন, আর বিলাপ করছেন। কেউ আবার সুগন্ধা নদী তীরের মিনিপার্ক, ডিসিপার্ক, লঞ্চঘাট এবং ঘটনাস্থল দিয়াকুল এলাকায় ঘুরছেন। অন্তত নিখোঁজ স্বজনদের মৃতদেহ যেন বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন, সেই অপেক্ষায় আছেন স্বজনরা। ঝালকাঠি ও বরিশালের ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদল এবং কোস্টগার্ডের একটি টিম শহরের লঞ্চঘাট এলাকা থেকে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে। নিখোঁজদের উদ্ধারে ডুবুরি দল সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেছে। ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড ও নৌ পুলিশের পাশাপাশি জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্যরা উদ্ধার অভিযানে সহায়তা করছেন।
এদিকে শনিবার সকাল দশটার দিকে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তোফায়েল হাসানের নেতৃত্বে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ৭ সদস্যের তদন্ত দল ঝালকাঠির লঞ্চঘাট এলাকায় এসে আগুনে পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি পরিদর্শন করেন। লঞ্চের ইঞ্জিনরুমসহ বিভিন্ন কক্ষ ঘুরে দেখেন তারা।
Leave a Reply